মেহেদি হাসান
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষায় উন্নতি করতে না পারলে কোনো জাতিই বিশ্ব-দরবারে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত এবং সুসংহত করতে পারে না। এজন্যই নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো”। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতি না করতে পারলে লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করবে না। এজন্য স্বাধীনতার পরপরই মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯৭৩ সালে প্রায় ৩৭,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন যা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে একটি অবিস্মরণীয় মাইলফলক হয়ে রয়েছে।
জাতির পিতার দেখানো পথ ধরে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। বিগত প্রায় ১৫ বছরে প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ৫৪% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮.২৫% এবং ঝরে পড়ার হার ৪৯% থেকে হ্রাস পেয়ে ১৩.১% হয়েছে। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে (৫৯,০৫৫ থেকে ১,১৮,৮৯১ টি) এবং শিক্ষকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে (৩,৪৪,৭৮৯ থেকে ৬,৯৭,২০৩ জন)। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে প্রাথমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষকের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে (৫৯,০৫৫ থেকে ৮৯,৯০৬জন)। ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত উদ্যোগে ২৬,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয় (তথ্যসূত্রঃ ব্যানবেইস)। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থায় যথাযথভাবে প্রস্তুত করার জন্য বর্তমান সরকার সারাদেশে ৯০০১ টি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব এবং ৩০০ টি শেখ রাসেল স্কুল অব ফিউচার প্রতিষ্ঠা করেছেন(তথ্যসূত্রঃ আইসিটি অধিদপ্তর)। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের ফলে মেধাবী ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী হচ্ছে যার ফলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১ লক্ষ শিক্ষার্থীকে প্রায় ৩ কোটি টাকার উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। এভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে প্রাথমিক শিক্ষা উত্তরোত্তর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এসব উদ্যোগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্হার আরও সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হবে মর্মে আশা করা যায়। প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষাসহ সরকারের জনকল্যাণমুখী সেবাসমূহ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিক্ষা ও অন্যান্য সেবাসমূহে অবদান রাখার জন্য ব্যক্তিগত সার্বিক পারফর্মেন্স সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে প্রণোদনা প্রদানের কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। তাই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের ব্যবস্থাকরণ ও পরবর্তীতে স্বীকৃতি ও অনুপ্রেরণা নিশ্চিতকরণ, প্রতিষ্ঠানসমূহের সার্বিক কার্যাবলিতে গতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়নসহ জনসেবার মানোন্নয়ন, সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালীকরণ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান ও তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে অধিকতর জনমুখীকরণ ও জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটানো, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ এবং প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে অধিক কার্যকর একক হিসেবে প্রতিষ্ঠাকরণ- এসব উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে ‘স্থানীয় সরকার পদক’ চালু করা হয়। সকল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের জন্য উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অংশীজনদের এ উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ৫ জন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ৫ জন, উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান ৫ জনসহ মোট ২০ জন; পৌরসভা পর্যায়ে ৪ জন মেয়র, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ১৪ জন ও কাউন্সিলর ৪২ জনসহ মোট ৬০ জন; ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ৪৫ জন, সদস্য ৪০৫ জন (ইউনিয়ন প্রতি ৯ জন সাধারণ সদস্য), সংরক্ষিত মহিলা সদস্য ১৩৫ জন (ইউনিয়ন প্রতি ৩ জন মহিলা সদস্য), ইউপি সচিব ৪৪ জন (ইউনিয়ন প্রতি ১ জন), হিসাব সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ৪১ জন, দফাদার ৪৫ জন, মহল্লাদার ৩৯০ জন, ৪৫ জন পুরুষ উদ্যোক্তা ও ৪৫ জন নারী উদ্যোক্তাসহ মোট ১২৪০ জন অর্থাৎ সর্বমোট ১৩২০ জন অংশীজনদের এ কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
এ উদ্যোগে জনপ্রতিনিধিদের সার্বিক মূল্যায়নের জন্য ২০ (বিশ) টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয় যার মধ্যে একটি হলো ‘শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান’। ক্ষেত্রটির আওতায় ‘One chairman, one school’ ধারণাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ইউনিয়নের আওতাধীন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় সরাসরি মনিটরিং করছেন যার উপর ভিত্তি করে তাঁকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। ১০০ নম্বরের মধ্যে এ সূচকে ০৫ নম্বর ধার্য করা আছে। বর্ণিত কার্যক্রমের আওতায় প্রত্যেক চেয়ারম্যান তাঁর স্বনির্বাচিত প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও ঝরে পড়ার হার, শিক্ষকগণের উপস্থিতি ও পাঠদান, বিদ্যালয় পরিচালনা কার্যক্রম, অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় বৃক্ষরোপণ ও ফুলের বাগান, বিদ্যালয়ের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বোর্ড/সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলসহ অন্যান্য বিষয়াদি মনিটরিং করছেন এবং কোনো সমস্যা দৃষ্টিগোচর হলে নিজ উদ্যোগে সমাধান করছেন অথবা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে বিস্তারিত তথ্যাদিসহ উপস্থাপন করছেন। উপজেলার সকল অফিসারকে সাথে নিয়ে এ কার্যক্রমটি সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধান ও দেখভাল করছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ।
‘স্থানীয় সরকার পদক’-এর আওতায় ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ৩ (তিন) স্তরবিশিষ্ট মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে যাদের মাধ্যমে ‘শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান’-সহ অন্যান্য সূচকের কার্যক্রম যাচাই করে সেরা জনপ্রতিনিধি/কর্মকর্তা/কর্মচারী/উদ্যোক্তা নির্বাচিত করে পুরস্কৃত করা হয়। প্রান্তিক পর্যায়ে ‘One chairman, one school’ ধারণাটি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাঝে এক সুস্থ প্রতিযোগিতার অবতারণা করেছে যে প্রতিযোগিতার সম্যক ফলাফল ‘ভালো কাজে তৃপ্তি প্রাপ্তি’। এভাবে এ জেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাঝে ভালো কাজ করে যে তৃপ্তি পাওয়া যায়, সে তৃপ্তি প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয়, তা বাস্তবায়ন করতে চাইলে স্থানীয় সরকার কাঠামোর জনপ্রতিনিধিদের স্মার্ট হিসেবে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আমি বিশ্বাস করি ‘স্থানীয় সরকার পদক’ -এর আওতায় ‘One chairman, one school’ ধারণাটি ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন যার সুফল চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাধারণ জনগণ ও কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পেতে শুরু করেছে। এ উদ্যোগের ফলে এ জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে উপস্থিতির হার খুবই আশাব্যঞ্জক এবং ঝরে পড়ার হার খুবই কম। বিদ্যালয়গুলোতে বৃক্ষরোপণ ও ফুলবাগান কর্মসূচি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। লেখাপড়ার পরিবেশেরও ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। শিশুদের আনন্দময় শৈশব ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকারের সকল কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে।
এভাবেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তাদের হাত ধরেই দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ-এই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ কে এম গালিভ খাঁন, জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।