কষ্টের প্রবাস : মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের লড়াই - মহসিনা মাসুম

মেহেদি হাসান

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর উন্নত জীবন ও পরিবারের সচ্ছলতা ফেরার আশায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা পাড়ি জমান। তাদের পছন্দের তালিকায় অন্যতম পছন্দের একটি দেশ হলো মালয়েশিয়া। কিন্তু সেখানে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের পোহাতে হয় সময়, অতিরিক্ত কাজের বোঝা, অতিরিক্ত ঋণ, ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিবেশহীন কর্মসংস্থানের মতো সমস্যাগুলোতে। উদাহরণ হিসেবে কাওয়াগুচি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির কথাই ধরা যাক। এই কোম্পানিটি মূলত প্যানাসনিক, সনি ও দাইকিনের মতো জাপানিজ কোম্পানিগুলোর জন্য প্লাস্টিকের যন্ত্রাংশ তৈরি করত। ওই কোম্পানিটি ২০২৪ সালের শেষের দিকে বন্ধ হয়ে গেলে ২৮০ বাংলাদেশিসহ অনেকের টাকা আটকে যাই।

শ্রমিকরা তাদের নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করেন। কখনো কখনো দিনে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। আবার অনেকে সপ্তাহে ৭ দিনই কাজ করেন। এমনকি তারা কোন ছুটিও পান না। এপি নিউজকে একজন শ্রমিক বলেনÑ ‘আমরা প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতাম। আমাদের সপ্তাহের ৭ দিনই কাজ করতে হতো। আমরা কোন বিশ্রামের সময় বা ওভারটাইমের জন্যও কোন বেতন পেতাম না। আর যদি কোনো দিন আমরা ছুটি নিতাম, তবে সেইদিন আমরা বেতনই পেতাম না।

শ্রমিকদের এই সমস্যার উংপত্তি হয় তার চাকরি শুরুর আগে থেকেই। অনেক শ্রমিককে তার বিদেশে যাওয়ার আগেই একটা মোটা অঙ্কের কমিশন দিতে হয় তার এজেন্টকে। যার পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ডলারেরও বেশি। 

এই অর্থ যোগাড় করার জন্য তারা তাদের বাড়ি- ঘরসহ জীবনের সব সঞ্চয় বিক্রি করে বা সম্পদের বিনিময়ে উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ফলে এই ঋণ শোধ করার জন্য তারা বাধ্য হয় সবচেয়ে কষ্টকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতেন। বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। যেমনÑ তারা চাষাবাদজনিত কাজ করে যেখানে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি বা নির্মাণ কাজ করে যেখানে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেশি। ব্র্যাকের শরিফুল ইসলাম হাসান এপি নিউজকে এসব কথা জানিয়েছেন।

এ সমস্যার শুরু হয় ১৯৮০ সালের শেষের দিকে যখন মালয়েশিয়ার অর্থনীতি দ্রুত বাড়তে থাকে। এই সময় মালেশিয়ার দ্রুত নগরায়নের কারণে ছেলেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যান এবং নারীরা ঘরের বাইরে কাজের সাথে যুক্ত হন। যার ফলে শ্রম বাজারে শ্রমিকের চাহিদা দেখা দেয়ায় দেশটি বিদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া শুরু করে। সেই সময় ১ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় কাজ করার সুযোগ পান। কিন্তু সেই সময়, এজেন্ট নিয়ন্ত্রণ, শ্রম সুরক্ষা, পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে শ্রমিকরা শোষণের শিকার হতেন।

বর্তমানে পাসপোর্ট জব্দ, ভিসা বিলম্ব এবং অনুপযুক্ত বাসস্থানের মতো সমস্যা রয়েই গেছে। ভিসা জটিলতার কারণে অবৈধ শ্রমিকদের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়Ñ ৭০ শতাংশেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক তাদের আয়ের অর্ধেকের বেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় করছেন।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা তাদের সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিয়ে কাজ করলেও তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে পারলেই এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। তাই উভয় রাষ্ট্রেরই উচিত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। 

না হলে বিদেশের মাটিতে আরও বহু শ্রমিক একই ধরনের সমস্যার শিকার হবেন।

প্রসঙ্গত, এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্যগুলো এপি নিউজ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, টেনাগানিটা, ব্র্যাক এবং অন্যান্য গবেষণা ও প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে সংগৃহীত। এখানে দেওয়া পরিসংখ্যান, ঘটনা এবং শ্রমিকদের বিবরণ এসব সূত্র থেকে নেয়া হয়েছে।

মহসিনা মাসুম : শিক্ষার্থী জিয়ামেন ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া

কপিরাইট © চাঁপাই নিউজ ডট কম ২০২৫ । সর্বসত্ব সংরক্ষিত।