লকডাউন চলমান: বাঁচতে ঘরেই থাকি

মেহেদি হাসান

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ পৃথিবীর সর্বত্র যুদ্ধ শুরু করেছে। ২০১৯ সালে শুরু করে আমাদের দেশে এখনও যুদ্ধ চলমান। আমরা এ অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা তেমন কোন আগ্নেয়াস্ত্র বা পারমানবিক অস্ত্র দিয়ে এর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করছি না। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি মাস্ক, হ্যান্ড ওয়াস আর স্যানিটাইজার দিয়ে।

বাংলাদেশের বিভন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময় কোভিড-১৯ এর ব্যাপক বিস্তার দেখা দেয়। সরকার ও প্রশাসন করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ঈদের পর বর্তামানে বাংলাদেশের সর্ব পশ্চিমের জেলা ও আমের রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির পরামর্শক্রমে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছেন। যদিও বর্তমানে দেশের সর্বত্র লকডাউন চলমান। কিন্তু যানবাহন ও বাজার-ঘাট অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই চলছে বলে জেলা প্রশাসন চাঁপাইনবাবগঞ্জকে সাত দিনের কঠোর লকডাউন পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন পরিস্থিতি খারাপ হলে এ লকডাউন বৃদ্ধি করা হতে পারে।

ঈদে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘরমুখো মানুষ নাড়ির টানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফিরে এসেছেন। অনেকেই আবার ভারত থেকে সোনামসজিদ সীমান্ত দিয়ে এসেছেন। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর ব্যাপক বিস্তার ঘটে। দেশে যখন চার-পাঁচ হাজার কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে এমন রোগী চিহ্নিত হতো হাতেগোনা কয়েকজন। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন সত্তর-আশি করে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হচ্ছে। আবার প্রতিদিন টেস্টে শতকরা পঞ্চাশ-ষাট ভাগ করোনা পজেটিভ হচ্ছে। তাই বর্তমান জেলা প্রশাসন লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী তাদের সাময়িক ক্ষতি হলেও এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয় এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এর আগে বিভন্ন সময় কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঠেকাতে নিজারাই বাঁশ বেঁধে রাস্তা বন্ধ করে লকডাউন পালন করেছি। কেউ বাহির থেকে আসলে নিজ দায়িত্বে হোম কোয়ারান্টাইন পালন করেছে। কিন্তু সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে দলে দলে মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঈদ করতে বাড়ি এসেছে। কেউ ট্রাকে করে আবার কেউ মাইক্রো ভাড়া করে। কিন্তু এসব যানবাহনে স্বাস্থ্যবিধির কোন নিয়মই পালন করা হয়নি। আবার অনেকেই ভারত থেকে সোনামসজিদ সীমান্তে দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে। তাই করোনার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে বলে আমরা শঙ্কা করছি।

আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী ঈদের সময় অনেকক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারিনি। তাই করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর ব্যাপক বিস্তার শুরু হয়েছে। তাই প্রশাসন বাধ্য হয়ে লকডাউন ঘোষণা করেছেন। এখন আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে প্রশাসনের ঘোষণা নির্দিধায় মেনে নেয়া। এবার লকডাউনে কোন ধরণের যানবাহন চলবে না। নঁওগা ও রাজশাহী থেকে কোন যানবাহন প্রবেশ করতে দেয়া হবে না এবং জেলা থেকে কোন যানবাহন বাহিরে যেতে দেয়া হবে না। অর্থাৎ কেউ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাহিরে যেতে পারবো না। প্রশাসনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং নিজেদেরকে করোনা থেকে বাঁচাতে লকডাউন পালনে সর্বত্মক সহযোগিতা করতে হবে।

আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ব্যবসায়ীরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেজন্য প্রশাসন আম পরিবহনে কোন বাধা দিবে না। বরং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাসায়নিকমুক্ত আম পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কৃষকরা আম সংগ্রহ ও বিপনন করতে পারবেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে যদি কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ে তবে কৃষকরা সহজেই আমের বাজারজাত করতে পারবেন না। তাই আমাদেরকে জেলা প্রশাসনের সর্বাত্মক লকডাউন পালনে সহায়তা করতে হবে।

বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলছে ধান কাটা মৌসুম। ধান কেটে কৃষকরা আনন্দে ঘরে ফিরছেন। অন্যদিকে সমানতালে চলছে আম পাড়ার উৎসবও। কিন্তু বিভিন্ন সময় হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হচ্ছে বলে অনেকে ভিজে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ঠান্ডা বা খুশখুশে কাশি থেকে শুরু হচ্ছে তীব্র জ্বর। আর শেষ পর্যায়ে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই আমাদেরকে বৃষ্টি থেকে দূরে থাকতে হবে। শিশু ও বৃদ্ধরা যেন কোনভাবেই বৃষ্টিতে না ভিজে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

বর্তমানে স্কুল-কলেজ বন্ধ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা তাঁরা ক্লাসে ফিরে যাবেন। সরকারও বার বার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন। কিন্তু করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে অনেক শিক্ষক বাড়িতে গাদাগাদি করে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। এটা সত্যি সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি এক ধরণের বৃদ্ধঙ্গলি দেখানো। অনেক শিক্ষক আবার বিভিন্ন সময় ভ্রমণে বের হচ্ছেন। এমন হলে প্রশাসনের পক্ষে লকডাউন দিয়েও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে।

বর্তমানে জরুরী সেবা দেয়ার জন্য ব্যাংক খোলা রাখা হয়েছে। অর্থনীতির গতি সচল রাখতে এবং মানুষ যেন সেবা নিতে পারে সেজন্যই এমন সিদ্ধান্ত। বর্তমানে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর একটা উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে ব্যাংক। কিন্তু মানুষ আগের মতোই ব্যাংকে স্বাভাবিকভাবেই আসছেন। স্বল্প পরিসরে বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য ব্যাংক চালু রাখা হলেও গ্রাহকরা বিশাল পরিসরে দীর্ঘ সময় ব্যাংকে অবাধে যাতায়াত করছেন। এতে  করোনা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হবার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। তাই আমাদেরকে ব্যাংকে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে একটু সচেতন হতে হবে।


দেশের মানুষকে নিরাপদে রাখতে সরকার ও প্রশাসন বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে শ্রমজীবীদের অসুবিধা হচ্ছে বেশি। সরকার বিভিন্নভাবে তাদের খাদ্য সহায়তা করছেন। আবার স্থানীয় পর্যায়ে অনেক স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তি ও সংগঠন এগিয়ে আসছেন। সাময়িক কষ্ট হলেও জাতীয় স্বার্থে আমাদেরকে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। 

করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধে আমাদেরকে তেমন ভারি অস্ত্র নিয়ে নামতে হবে না। বরং সচেতন হয়ে বাড়ির ভিতর অবস্থান করে নিয়ম মানতে হবে। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাহির হবো না। আতঙ্ক না হয়ে আমরা নির্ভিকভাবে সচেতন হবো। হাঁচি-কাশি আসলে অবশ্যই টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করবো। খাওয়ার পূর্বে-পরে এবং বিভিন্ন সময়ে অবশ্যই সাবান দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিবো। অতীত এবং পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আমাদের কঠোর নিয়ম মানতেই হবে। লকডাউনে নিয়ম মানি আর ফিরে আসুক সুদিন এই হোক আমাদের কমনা।

লেখক: শাহাদাত আনসারী

[গবেষক ও কলাম লেখক]

ansarisahadat4@gmail.com

কপিরাইট © চাঁপাই নিউজ ডট কম ২০২৪ । সর্বসত্ব সংরক্ষিত।