মেহেদি হাসান
ড. মো. সাইদুর রহমান ও ড. মো. শরফ উদ্দিন
করোনার প্রভাবে গোটা পৃথিবী আজ স্তব্ধ। করোনার থাবা থেকে রেহাই পাবার জন্য মানুষ বস্তুত ঘরে আবদ্ধ হয়ে আছে। ধর্ম, বর্ণ, ধনী, দরিদ্র, উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নোত সকল বিবেচনায় মানুষের করোনা এক আতঙ্কের নাম। এ আতঙ্ক থেকে মানুষ কবে নাগাদ সাধারণ জীবন যাপনে ফিরে আসতে পারবে তা অনিশ্চিত। তবুও মানুষ বেঁচে থাকার বাসনায় নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং খেটে খাওয়া কর্মজীবি মানুষজন বেশি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তারা না পারছে অন্যের নিকট হাত পাততে, না পারছে চুপ করে বসে থাকতে। সরকার তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েও যেন সবার মন রক্ষা করতে পারছে না। কৃষিতে ৯ হাজার কোটি টাকা ভতৃুকি ও ৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষনা এবং ২৬ টাকা কেজি দরে ৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের ঘোষনা করেছে যা অত্যন্ত প্রশংসার দাবী রাখে। মাননীয় কৃষি মন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক কৃষির সকল ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎপাদন পেতে সব ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন। হাওরের ধান কাঁটা শুরু হয়েছে এবং তার জন্য ধান কাঁটার যন্ত্রসহ কৃষি শ্রমিক যোগান দেবার সকল ব্যবস্থা সরকারিভাবে করা হয়েছে। করোনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিকে প্রধানতম নির্ভরযোগ্য খাত হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবেলার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছেন। আশা করা যায় প্রকৃতি আমাদের সহায় হলে কৃষক বোরো ধান পুরোপুরি কেঁটে ঘরে তুলতে পারবে এবং সে ক্ষেত্রে মানুষের প্রধানতম খাদ্য ভাতের ঘাটতি হবে না।
চিকিত্সক এবং বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, করোনায় আক্রান্ত হলে তা থেকে রেহাই পাবার মূল হাতিয়ার হলো শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যা দিয়ে করোনাকে পরাজিত করা যায়। এ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশে নানা ধরণের দেশী ফলমূল রয়েছে যার মধ্যে আম, কলা, আনারস, তরমুজ, পেয়ারা, বড়ই, প্রভৃতি অন্যতম যেগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া সম্ভব। বাঙালির নিকট বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মধুমাস হিসেবে পরিচিত।এ মাসে প্রচুর দেশী ফল বাজারে আসবে। এ মুহুর্তে বাজারে তরমুজের যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে পছন্দের ফল হলো আম যাকে ফলের রাজা বলা হয়। আমে প্রচুর পুষ্টিগুন রয়েছে। প্রতিদিন জনপ্রতি ২০০ গ্রাম করে আম খাওয়ার প্রয়োজন থাকলেও আমরা গ্রহণ করি মাত্র ৮২ গ্রাম।
ইতোমধ্যে মৌসুমের শুরুতে মানুষ ডালে কাঁচা আমের ব্যবহার করছে এবং কাচা মরিচ ও কাসুন্দি দিয়ে কাচা আম খাওয়া যেন বাঙালির একটি কাংখিত অভ্যাস। আমের আচার তৈরির প্রস্তুতিরও যেন কোন কমতি নেই। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পর্যায়ক্রমে আম বাজারে আসবে এবং তা শুরু হবে সাতক্ষীরা অঞ্চলের গোবিন্দভোগ আম দিয়ে। এর পরই বাজারে আসবে গোপালভোগ, হিমসাগর, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, বারি আম-২, ফজলি, বারি আম-৩, বারি আম-৪ এবং আশ্বিনা আম দিয়ে মৌসুম শেষ হবে। সাধারণত দেখা যায় মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৬০-৭০ ভাগ মৌসুমী ফল বাজারে আসে। প্রধান প্রধান আম উৎপাদনকারী জেলা হলো চাঁপাইনবাবগঞ্ছ, রাজশাহী, নওগাঁ, রংপুর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা এবং পার্বত্য জেলাগুলো। বর্তমানে ২৩ জেলায় বানিজ্যিকভাবে আম চাষাবাদ হয়ে থাকে এবং উল্লেখিত জেলাগুলোর ৪১,৬৭৬ হেক্টর এলাকায় ১২.৮৮ লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয় যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১০-১২ হাজার কোটি টাকা (বিবিএস, ২০১৯)। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যসূত্র মোতাবেক দেশে মোট আম উৎপাদনের পরিমাণ ২৩ লক্ষ মেট্রিক টন।আমের উৎপাদন সম্পর্কিত এ তথ্য বিভ্রাট সুরাহা করা উচিত । আম উৎপাদন জেলাগুলোর প্রায় ৮০-৮৫ ভাগ মানুষ আম উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ কাজে নিয়োজিত থাকে।
বিভিন্ন জেলায় উৎপাদিত আম সারা দেশে বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনী, কুমিল্লায় বাজারজাতকরণ করা হয়ে থাকে। আম উৎপাদনের পর তা সংগ্রহ করে আড়তে জমা করা হয় এবং সেখান থেকে এজেন্ট বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ট্রাক, বাস, ট্রেন, কাভার্ডভ্যান, ভডভডি ও ভ্যানে করে আমের বাজার তথা বিভিন্ন জেলায় পৌঁছানো হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আম পৌছানো হয় রাজধানী ঢাকায়। করোনার কারণে আগামী ৭ মে পর্যন্ত সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির পরও পরিসি’তি স্বাভাবিক না হলে আম সংগ্রহ ও বিভিন্ন ’ানে পৌঁছানোতে ব্যাপক সমস্যা হবে বলে আশংকা রয়েছে। সকলের প্রিয় এই ফলটিকে কিভাবে মানুষের নিকট ভালভাবে পৌঁছানো যায় তার আগাম পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি তা না হলে আম চাষী এবং ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বে। আম একটি দ্রুত পচনশীল ফল এবং সে কারণে আমের বাজার খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা বলে মে মাসে প্রায় ১ লক্ষ মেট্রিক টন, জুন মাসে ৫ লক্ষ মেট্রিক টন, জুলাই মাসে ৪ লক্ষ মেট্রিক টন এবং বাকি ৩ লক্ষ মেট্রিক টন আম আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বাজারে আসে। সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ৫০০-১০০০ মেট্রিক টন আম কেনাবেচা হয়ে থাকে।
করোনার বিস্তৃতি এবং সংক্রমণ অব্যাহত থাকলে আম বাজারজাতকরণে আমচাষী এবং ব্যবসায়ীরা ভীষণ অসুবিধার সম্মুখীন হবেন কারণ করোনা ঠেকাতে দোকানপাট বন্ধ এবং পরিবহণ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার প্রয়োজন হবে। বন্ধ থাকতে পারে আমের আড়ত এবং কুরিয়ার সার্ভিসসমূহ। এগুলো বহাল থাকলে আমচাষীরা আমের মূল্য পাবে না ফলে তারা জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে দারুণ বিপাকে পড়বে। তাই ধান কাঁটার শ্রমিক সরবরাহের ন্যায় স্বাস’্য বিধি মেনে আম সংগ্রহ ও পরিবহণের ক্ষেত্রে সরকারের আশু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া আম পরিবহণের গাড়িগুলো চলাচলে অনুমতি দেয়া, আমের আড়ত ও এজেন্ট এবং কুড়িয়ার সার্ভিসগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা করা অন্যথায় উল্লেখিত জেলাগুলোর আমচাষীদেরও বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের যৌক্তিক দাবী উঠবে। লেখাটি বনিক বার্তা অনলাইন থেকে নেয়া
লেখকদ্বয় যথাক্রমে অধ্যাপক, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনহসিংহ এবং ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর