আজ শনিবার, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১, ২০শে এপ্রিল ২০২৪

মন্ডল পরিবারের শুভ মিলনী

News Desk

জাকিয়া রহমান, লিমেরিক, আয়ারল্যান্ড : মহানন্দানদীর পাড়ে একস্মরণীয় অনুষ্ঠান ‘মন্ডল পরিবারের শুভ মিলনী’তে আমি অংশ নিয়েছিলাম। সেদিন হাড় কাঁপানো শীতের ভোরে, নামো-রাজারামপুর গ্রামের মেঠো পথ ধরে দলে দলে মানুষ চলছিল। উদ্দেশ্য সকাল ৮টা নাগাদ পরিবারের আদিভিটায় পৌঁছান। বাচ্চারা তিড়িং তিড়িং করে নাচতে নাচতে চলেছে, সঙ্গে বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা। তাদের মা-বাবা আর রয়েছেন দাদী, দাদা, বড়মা (দাদার মা) অর্থাৎ চার প্রজন্মের আত্মীয়। সব মণ্ডল পরিবারের লোকজন। দারুণদৃশ্য!

কারা এই মণ্ডল পরিবার? বিশ শতকের গোড়ার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা থেকে জেলা হয়। সেই জেলার সদর থানায় অবস্থিত নামোরাজারামপুর গ্রাম। সেখানে একটি কৃষক পরিবারের প্রধান পুরুষের নাম ছিল ওসমান মণ্ডল। শোনা যায়, অন্য কোন অঞ্চল হতে পিতা দৌলত মণ্ডলের অকাল মৃত্যুর পর তাঁর মাতা তাঁকে নিয়ে এই গ্রামে চলে আসেন। সেই আমলে গ্রামীন মানুষের প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ, ওসমান মণ্ডলও তাই করতেন। তাঁর ঘরে সন্তান-সন্তুতি জন্ম এবং পরিবার বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে অষ্টম প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃতহ হয়েছে এবং সদস্য সংখ্যা ছয়শত ছাড়িয়ে গেছে।

ওসমান মণ্ডলের পরিবারে যারা অন্তর্ভুক্ত তারাই এই পরিবারের সদস্য এবং 'মণ্ডল পরিবার' বুঝায়। শুভ মিলনী অনুষ্ঠিত হবে আদি ভিটাতে, যেখানে শ্রদ্ধেয় ওসমান মণ্ডল সংসার পেতেছিলেন। পরে, তার ছেলেরা সংলগ্ন জমি অনেক ক্রয় করেছেন ফলে, জায়গা অনেক খানি বেড়েছে। ভিটার এক অংশে পারিবারিক গোরস্থান সংযোজিত হয়েছে। আমারশশুর হাজী সিরাজুল ইসলাম ছিলেন হামিদুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, তিনি শ্রদ্ধেয় ওসমান মণ্ডলের পঞ্চম পুত্র। সেখানেই প্রধানত, সমস্ত কর্মসুচীর ব্যবস্থাপনা করা হয়েছিল।

কর্মসুচীর অন্তর্গত ছিল সম্বর্ধনা, মুনাজাত, আপ্যায়ন, প্রদর্শনী, বিনোদন, প্রতিযোগীতা ইত্যাদি। অন্যান্য চাচাদের বাড়ীতে পিঠা তৈরি এবং কিছু মানুষের আরাম ও বিশ্রাম ইত্যাদিরও ব্যবস্থা ছিল। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার ভার নিয়েছিল আমার দেবর হাজী মো: র‌ফিকুল ইসলাম ও তার একমাত্র পুত্র আব্দুর র‌হিম সবুজ। এই দলে উল্লেখ্যযোগ্যরা হলেন, আলমগীর বুধু, ফ‌রিদউদ্দীন ফ‌রিদ, শরীফউদ্দিন শরীফ ও জহুরুল হক। সামিয়ানা, বাড়ী সাজান, রান্না-বান্না সে এক মহাকান্ড। আমি ছিলাম হুকুম করনেওয়ালী! উৎসবটি কিসের জন্য? পরিবারের সদস্যদের কয়েকজন ছাড়া কৃষিকাজে আর কেউ জড়িত নেই। বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়ে সারা বাংলাদেশে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করে।

সুতরাং, পরিচয় এবং যোগাযোগ ক্ষীণহতে ক্ষীণতর হয়েছে।কোন কোন ক্ষেত্রেপ্রায় বিলুপ্তির পথে। তদুপরি, নতুন প্রজন্ম তাদের ‘আদি ভিটা’ সম্পর্কে আগ্রহী নয়। তারা গ্রামের পরিবেশ ও সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক বিরূপ ধারণা পোশন করে। তাই নিজের আত্মীয়দের সম্বন্ধে জানতেও উদাসীন। এ সমস্যার সমাধান নিয়ে আমার চাচাত দেবর ডাঃ শফিউল আলম প্রায় পাঁচ ছয় বছর আগেই তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।

আমি প্রবাসী। ২০১৬ সালে দেশে বেড়াতে আসলে শফিউল তার আভিপ্রায়ের কথা আমার সাথে আলোচনা করল। তার ইচ্ছা, মণ্ডল পরিবারের যত আত্মীয়-স্বজন রয়েছে তাদের এক জ্ঞাতিত্বতে বাঁধতে হবে। তার জন্য প্রথমেই যা দরকার তা হল, সবাইকে খুঁজে বের করা। সে গত কয়েক বছর থেকেই মন্ডল বংশের ইতিহাস, জীবিত এবং মৃত সব সদস্যের আদ্য-পান্ত লিপিবদ্ধ করার কাজে নিজেকে নিয়জিত করেছিল। লক্ষ্য ছিল, মণ্ডল পরিবারের ইতিহাস ও সব সদস্যের বৃত্তান্ত পুঁথিগত করা ও বই ছাপিয়ে পরিবারের সবার কাছে পৌঁছানো। সবাইকে সব সময়ে সবার খবর অবহিত করার ব্যবস্থা করা। তারপর একটি দিন ধার্য করে সবাইকে নিয়ে একমহা সম্মিলনীতে একত্রিত হওয়া। এই মণ্ডলপরিবারে যা কোন দিন হয়নি। শফিউল আলম ব্যতিরিকে কেউ এমনটি চিন্তাও করেনি। এমনকি সারা এলাকাতেও কেউ কখনো শুনেনি বাভেবেও দেখেনি। এই অনুষ্ঠানে ডঃ শ‌ফিউল আলমের অভিপ্রায়ও পরিকল্পনা অনুযায়ী মণ্ডল পরিবার সম্পর্কে লিখিত পুস্তকের তিনটি অংশের মধ্যে প্রথম দুইটি বিতরণ করা হয়।

সে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই তিনটি বইটি প্রকাশ করার পরিকল্পনা ছিল। প্রথম অংশ 'কাউকে ভোলা হয়নি, কেউ হারিয়ে যায়নি'। এই অংশে রয়েছে পরিবারের জীবিত ও মৃত সদস্যদের নামের তালিকাও আইডি নম্বর যা একক ও অনন্য, এই নম্বর দিয়েই সেই ব্যক্তির বাবা-মা, দাদা-দাদীর পরিচয় বের করা যাবে। অর্থাৎ পরিবারের প্রথম পুরুষ থেকে তার অবরোহণের ধারা (Line of Descent) জানা যাবে। দ্বিতীয় অংশ, 'আমি তোমাদেরই লোক'। এখানে সদস্যদের ব্যক্তিগত তথ্য দেয়া হয়েছে, যেটা পড়ে সেই ব্যক্তির জীবন সম্বন্ধে কিছু ধারণা পাওয়া যাবে। তৃতীয় অংশ ' আমার পরিবার আমার পৃথিবী' আমরা আগামী বছর এই বইটি প্রকাশ হবে বলে আশা করছি।

উৎসবের কর্মসূচী অনুযায়ী সবাই সকাল আটটায় এসে পৌঁছানোর পর রে‌জিস্ট্রেশন, আইডি কার্ড সংগ্রহ, বায়োডাটা ফর‌মে বাদ পড়া তথ‌্য সং‌যোজন করা হলো। খাবারের আয়োজনে সকা‌লের নাস্তা, ১১-৩০ দিকে পিঠা, ১-৩০ নাগাদ দুপু‌রের খাবার, চা, পুনরায় পিঠা ও মিষ্টি পরিবেশন করা হয়েছে। ধর্মীয় দিকে ছিল নামাজ আদায়, কোরান শরিফ তেলাওয়াত, পূর্ব পুরুষদের গোরস্থান জিয়ারত ও মাগ‌ফেরাত কামনা। উদ্দীপনামুলক বিষয়ে ছিল বড় ও ছোটদের জন্য তিন রকমের খেলার আয়োজন, বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রতি‌যোগীতা যেমন, ‘আদি ভিটা’ মূল ভাবের উপর চিত্রাঙ্কন, কবিতা ও ছড়া এবং ছোট ও অনু গল্প। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় আবৃতি, জারীগান, নৃত্য, গজল ইত্যাদি। তাছাড়া, অসংখ্য চিত্রধারণ।

মণ্ডল প‌রিবা‌রের শুভ মিলনী উৎলক্ষ্যে কেক কাটা হয়। একটি ঘরোয়া পরিবেশে স্থানীয় মেয়েদের তৈরী কাঁথা, সুচী শিল্প ও নুতন প্রজন্মের অবগতির জন্য ফেলে আসা দিনের কিছু গৃহস্থলীয় জিনিস-পত্র প্রদর্শীত হয়। অনুষ্ঠানে বক্তব‌্য রাখেন, পরিবারের বর্তমান বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য শ্রদ্ধেয় মো: জাফর আলী মণ্ডল, শ‌ফিউল আলম ও আন্যন্য সন্মা‌নিত ব্যক্তিবর্গ। এই মিলনী যে কত বড় হতে পারে, সেই ধারণা পেতে আমাদের ২৪শে জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

সব তথ্য জোগাড় করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে এবং সব জোগাড় করাও সম্ভব হয়নি। কারণ, গ্রামের মানুষ বেশির ভাগই ফেসবুক কি জানেনা, তাদের কোনো কম্পিউটার ল্যাপটপ বা এধরনের তথ্য সংগ্রহ করার যন্ত্র বা কেমন করে সংগ্রহ করতে হয় তার সম্বন্ধে জ্ঞান নেই। বেশির ভাগ সদস্যই দেখা গেল, আমাদের কর্ম কান্ড অনুধাবন করতে পারেননি। অনেকেই সে রকম সুযোগও নেই। একটি দুঃখজনক বিমুখতা আমি লক্ষ্য করেছি, তা শহুরে নূতন প্রজন্মের গ্রাম অনীহা। দায়িত্বশীল ও শিক্ষিত পূর্ণ বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে আনুষ্ঠানে সবার কাছ থেকে দূরে থাকতে দেখলাম।

বুঝলাম গ্রামে আসা কষ্টকর, কত জায়গা পূঁতি গন্ধময় এসব হাজারো সমস্যা। কিন্তু এই গ্রামেই তাদের পিতা-মাতা সবাই বড় হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা নিয়ে আজ পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। গ্রামেই অর্জিত হয়েছে মানুষ হবার চেতনা। আমরা প্রবাসী ও শহুরে বাসিন্দারা যদি গ্রামের সমস্যার কথা পুরোপুরি বুঝতে না পারি তাহলে, আমরা কেমন মানুষ হলাম? আমার মতে, এধরণের অনুষ্ঠান ‘আদি ভিটা’ মানস চোখে দর্শন, স্মৃতি মন্থন নুতন প্রজন্মের ও শহুরে নবীণদের জন্য একটি জীবনের স্পর্শমণি (Elixir of life) খুঁজে পাওয়ার মত।

অত্যন্ত আনন্দায়ক পরিবেশের মাঝে সারাদিন প্রায় ৬০০ জনের বেশী পরিবার সদস্যের সাথে পরি‌চি‌তি, শু‌ভেচ্ছা বিনিময়, স্মৃ‌তিচারণ ও অনুভূ‌তি প্রকাশ করেঅনুষ্ঠানের সমা‌প্তি হয় প্রায় রাত্রি আটটার দিকে। কাঠের চুলায় উন্মুক্ত বাতাসে অপূর্ব সুস্বাদু রান্নার সুবাস ও স্বাদ ছিল অতুলনীয়। সেদিন প্রকৃতি যেন সাদরে ডেকে নিয়েছিল সবাইকেতার স্নেহ নন্দিত কবোষ্ণ বক্ষে আর আনন্দে বইছিল মহানন্দা!


মন্তব্য সমুহ
০ টি মন্তব্য
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন
এই শ্রেনির আরো সংবাদ

ফিচার নিউজ